যাত্রাবাড়ী-বাড়ার অবস্থা কেমন, চলছে ব্যাপক ধরপাকড়
টানা পাঁচ দিনের সহিংসতার পর মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। যেখানে বেশি সহিংসতা হয়েছে সেসব জায়গার বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। তবে সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালায় পুলিশ।
ঢাকা মহানগরীর কয়েকটি থানা ও আদালতে গিয়ে দেখা গেছে, সহিংসতার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও শ্রমজীবী মানুষ।
মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৬১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কতজন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী রয়েছে তা জানাতে পারেননি তারা।
বিবিসি বাংলা দেশের বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে জানতে পেরেছে, গ্রেপ্তারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, গত দুই দিনে শুধু ঢাকাতেই ১১১৭ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘটনাস্থল যাত্রাবাড়ী
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই নারী। একজন মমতাজ বেগম, অন্যজন সালমা বেগম। থানার সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহারায় রয়েছে।
দুজন জানান, মঙ্গলবার ভোর ৪টার দিকে পুলিশ তাদের কিশোর ছেলেকে বাড়ি থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
এরপর থেকে তারা টানা ১০ ঘণ্টা থানার সামনে অপেক্ষা করছেন। মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও র্যাব ব্যাপক অভিযান চালায়।
মমতাজ বেগম ও সালমা বেগমের বাড়ি যাত্রাবাড়ী থানার ধোলাইপার্ড এলাকায়।
সালমা বেগম জানান, তার ছেলের বয়স ১৬ বছর এবং সে স্থানীয় একে উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
“ভোর চারটার দিকে বাড়ির দরজায় টোকা পড়ে। বলছে আমরা পুলিশ, তোমার ছেলের সঙ্গে কথা বলব। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটজন লোক আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমার ছেলে আমি বলছিলাম, মাইরেন না, ওকে নাও,” সালমা বেগম বিবিসি বাংলাকে বলেন।
শনিবার কাঁধে গুলিবিদ্ধ হন সালমা বেগমের ছেলে তামিম রহমান। ছেলে অসুস্থ বলে দাবি করেন তিনি। হাইভের একটি হাসপাতালে ডাক্তারের পরিদর্শন থেকে ফেরার সময় তিনি রাস্তায় সংঘর্ষে পড়েন। এরপর গুলিবিদ্ধ হন তামিম রহমান।
“পুলিশ ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাঁধে গুলি লেগেছে। তুমি পুলিশকে মেরে ফেলো। আন্দোলনে গিয়েছিলে। নীলের গুলি কেমন হয়? আমি বললাম- স্যার, আমার ছেলে অসুস্থ। আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম, সবাই। নথিপত্র আছে, পুলিশ কিছুই শুনতে পায়নি।
সালমা বেগমের মতো একই অবস্থা মমতাজ বেগমেরও। তার ছেলের নাম নাদিম ভূঁইয়া এবং তার বয়স ১৫ বছর। ছেলেটি দশম শ্রেণীর ছাত্র।
মমতাজ বেগম বলেন, “পুলিশ আইসা বলল দরজা খোল। আমি তার সাথে অন্য কাউকে পাবো। দরজা খোলার সাথে সাথে ছেলের কন্ঠস্বর কর্কশ হয়ে বললো- তুমি পুলিশকে মেরে ফেলছ”।
এসব ঘটনা নিয়ে যাত্রাবাড়ী পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বিবিসি সংবাদদাতাদের প্রবেশ করতে দেয়নি গেটে পাহারায় থাকা পুলিশ।
“থানার পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত। সাংবাদিকদের কৌরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ডিসি স্যারও ভিতরে আছেন,” বললেন গেট পাহারা দেওয়া এক পুলিশকর্মী।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকা।
মঙ্গলবার বিকেলে যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, রায়েরবাগ, শনির আখড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পুরোপুরি শান্ত। কিছু দোকানপাটও খুলেছে। বিকেল চারটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেশ কিছু অটোরিকশা ও প্রাইভেট যান চলাচল করতে দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন লেগেছে। এ ছাড়া মহাসড়কের পাশে কয়েকটি পোড়া গাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত দুই দিনে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সহিংসতার বিভিন্ন চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বাড্ডা এলাকার চিত্র
কোটাবিরোধী আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের অন্যতম কেন্দ্র ছিল বাড্ডা ও রামপুরা এলাকা। বুধবার বিবিসির সংবাদদাতা এসব এলাকার গলি পরিদর্শন করেন। এসব এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছে এবং এখনো চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বিবিসি বাংলাকে জানান, সোমবার বিকেলে উত্তর বাড্ডার তেতুলতলা এলাকা থেকে পুলিশ ১২ জনকে আটক করে। তাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় এক ছোট হোটেলের কর্মচারী মো. গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সোহেলও একজন। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, দুপুর ২টার দিকে তাকে আটক করা হয় এবং খবর পেয়ে মঙ্গলবার ভোর ৪টার দিকে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।
“পুলিশ এলাকায় প্রবেশ করলে আমি দৌড়ে ছাদে যাই। ছাদ থেকে সব দেখছি। পুলিশ এখানে এসে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়,” বলেন স্থানীয় এক যুবক।
বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকা থেকে ২৫ বছর বয়সী আহাদুল ইসলাম বাদলকে আটক করেছে পুলিশ। তার মা লিপি আক্তার বিবিসি বাংলাকে দাবি করেছেন যে তার ছেলে কোনো প্রতিবাদ বা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল না।
“আমার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। লিপি আক্তার বলেন, চারদিন ধরে যেখানে গঞ্জাম চলছে সেখানে আমার ছেলে যায়নি।
বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ‘পুলিশ আতঙ্ক’ রয়েছে। কখন কারা আটক হয় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।
মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে বাড্ডা থানার ডিউটি অফিসার বিবিসি বাংলাকে বলেন, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের তিনটি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় চার থেকে পাঁচ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। ডিউটি অফিসার জানান, গতকাল রাতে ৫০ জনকে আটক করে সকালে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
“তারা পাঁচবার আমাদের থানায় হামলা করতে এসেছিল। এটা আরো যে আমরা বেঁচে আছি,” ডিউটি অফিসার বলেন.
যা দেখা গেল আদালতের সামনে
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গ্রেফতারকৃতদের সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল তিনটার দিকে আদালতের সামনে গিয়ে দেখা যায়, আসামি বোঝাই একের পর এক প্রিজন ভ্যান আদালত চত্বরে প্রবেশ করছে এবং বের হচ্ছে। প্রতিটি প্রিজন ভ্যান আদালত চত্বরে প্রবেশের সময় আসামিদের বোঝাই ছিল।
কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানান, প্রতিটি ভ্যানে ৩০ থেকে ৪০ জন আসামি থাকে। প্রিজন ভ্যানগুলো যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, অনেক অভিযুক্ত জানালা দিয়ে নিজেদের নির্দোষ বলে চিৎকার করছিল।
আদালতের গেটের বাইরে কাঁদছিলেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা কুলসুম বেগম। তিনি জানান, নাখালপাড়ার লিচু বাগান এলাকায় একটি টিনের চালায় থাকেন। তার ১৩ বছরের ছেলে দুরন্ত আহমেদ কাইয়ুমকে দুদিন আগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কুলসুম বেগম জানান, কাইয়ুম একটি গ্যারেজে মেকানিকের কাজ করতেন।
কুলসুম বেগম বলেন, “৩০/৪০ জন পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়েছিল। আমার ছেলে আমার পাশে ঘুমাচ্ছিল। পুলিশ আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেছে।” তিনি দাবি করেন, তার ছেলে কোনো ধরনের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত নয়, আন্দোলনের কথাই বলা যায়।
শাহিনা খান আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে কথা বলছিলেন। তিনি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা।
তার ছেলে সামসুল হক খান রনিকে আটক করেছে পুলিশ। শাহিনা খান বলেন, তার ছেলে বিএনপির ‘সমর্থক’। এর আগে তিনি বেশ কয়েকটি মামলায় জামিনে ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর তিনি জানতে পারেন যে তার ছেলের বিরুদ্ধে ‘সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের’ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
“আমার ছেলে তাজমহল রোডে তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় র্যাব। আমার ছেলে বিএনপি করে এটা ঠিক। তিনি কোন কিছুর সাথে জড়িত ছিলেন না। বিএনপি করা কি অন্যায়?” প্রশ্ন তোলেন শাহিনা খান।
পুলিশ বলছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় যেসব জায়গায় সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি।
পুলিশের দাবি, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন থানার কর্মকর্তারা বলছেন, সবাইকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।