“এখন কার কাছে অভিযোগ করব বাবা…”
সুমি আক্তার (২৮) এক সপ্তাহ ধরে চুপচাপ, বাকরুদ্ধ। তিনি ঢাকায় গুলিবিদ্ধ অটোমোবাইল দোকানের ম্যানেজার জসিম উদ্দিনের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে সুমি পানি পান করছে না। দুইদিন ধরে পরিবারের সবাই জোর করে আমাকে একটু খাবার খাওয়াতে গেলেও আমি কারো সাথে কথা বলিনি। তার ১০ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসও মায়ের মতো চুপচাপ। ছোট্ট মেয়েটিও তার বাবার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে অভিভূত।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পূর্ব সলিকাবাঙ্কপুর। বরিশাল-বানারীপাড়া সড়ক থেকে উত্তর-পশ্চিমে আরেকটি সরু পিচের রাস্তা গেছে। এই রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে বাঁকপুর গ্রামের মাদ্রাসার পাশ দিয়ে আরেকটি সরু রাস্তা চলে গেছে সোজা পশ্চিমে। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তা কাদা। গতকাল বিকেলে মাটি মাড়িয়ে নিহত জসিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আশপাশ গাছে ভর্তি। বাড়িতে ঢুকেই মৃত জসিমের কবর চোখে পড়ে। জসিমের ভাই সাহাবুদ্দিন হাত তুলে বললেন, ‘ওখানে আমার ভাই পড়ে আছে।’
ছোট টিনের ঘরে তখন নীরবতা। সাহাবুদ্দিন তার বড় ভাই নিজাম উদ্দিনকে বাড়ির ভেতর থেকে বারান্দায় ডেকে আনেন। এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভাই, রাজনীতি করিনি। ২০ হাজার টাকা বেতনে ঢাকায় ছোট চাকরি করে স্ত্রী-সন্তানের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। নিজাম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জসিমের দেড় বছরের ছেলে সাইফ সাহাবুদ্দিনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। জসিমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মাথা নিচু করে মামার কান্নার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখ থেকে নীরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
ছোট্ট জান্নাতুল বলছিলেন, “আব্বা যিনি মারা গেছেন, সেদিন দুপুর ১২টায় আমাকে ডেকেছিলেন, “স্কুল ছাড়ার সময় তোমার মামার দোকান থেকে (এলাকার একজন পরিচিত দোকানদার) দাদির জন্য কিছু ফল নিয়ে যাও। আমি পরে টাকা শোধ করব।” এটাই ছিল বাবার সাথে শেষ কথা। বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বলছিলেন, ‘মা আমার ওপর রাগ করলে বাবাকে ডাকতাম। বাবা বলতেন, বাড়িতে এলে তোর মাকে অনেক বকাবকি করব। এখন কার কাছে নালিশ করবো বাবা…!’
নিজাম উদ্দিন জানান, চার ভাইয়ের মধ্যে জসিম সবার বড়। কয়েক বছর আগে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় যান জসিম। বাপের বাড়ির জমি ছাড়া আর কোনো জমি নেই। চার ভাই বাড়ির বাইরে থাকে, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে ছোট চাকরি করে। চার ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান বাপের বাড়িতে থাকে। তাদের বাবা আব্দুল মান্নান 2020 সালে অসুস্থ হয়ে মারা যান। মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী। স্বল্প বেতনে চার ভাই একরকম সংসার টানছিলেন। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এক ভাই চলে গেলেন।
নিজাম উদ্দিন জানান, জসিম উত্তরায় একটি অটোমোবাইলের দোকানে কাজ করতেন। ওই দোকানের গ্যারেজে থাকতেন। গত বৃহস্পতিবার গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশ কিনতে মালিকের নির্দেশে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে গিয়েছিলেন তিনি। কেনার পথে তাকে গুলি করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই জসিম মারা যায়। একটি বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়। মুখে ও সারা শরীরে রাবার বুলেটের অসংখ্য ক্ষত ছিল। খবর পেয়ে তিনি (নিজাম) তার কর্মস্থল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে যান। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তারা লাশ উদ্ধার করে শুক্রবার সকালে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। ফেরার পথে নিহত জসিমের স্ত্রী সুমি আক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বারান্দায় আসেন। ছোট সাইফ তখনও তার কাঁধে ঘুমিয়ে ছিল। তার বিধ্বস্ত মুখ দেখেই বোঝা গেল জীবনের ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নীরবতা ভেঙে মাথা নিচু করে শুধু বলছিলেন, ‘এই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাব, কী করব, কিছুই জানি না।’