একজন আমার ছেলের ফোন নিয়ে বলল, তোমার ছেলে মারা গেছে। তারপর সন্দ্বীপ থেকে রুক্ষ সাগর পাড়ি দিয়ে কিভাবে ঢাকায় এলাম বলতে পারব না। আমি কারো কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই না, আমি শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দেব।
মাহাবুবের রহমান এসব কথা বলছিলেন। তিনি মাহামুদুর রহমান (সৈকত) এর পিতা। গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের মাথায় (মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে) সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে মাহামুদুর রহমান নিহত হন।
গত শুক্রবার মাহাবুবের রহমান তার নূরজাহান রোডের বাড়িতে তার পোষা বিড়াল পুটুকে দেখিয়ে বলেন, ‘এটি একটি পশু, এই বিড়ালটি তার ছেলের মৃত্যুর পর থেকে খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। চুপচাপ বসে আছে ছেলের চেয়ারে। মাহামুদুর রহমান মারা যাওয়ার আগে এই বিড়ালের জন্য খাবার কিনেছিলেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান পরিবারের সদস্যরা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘বন্দুকের গুলি’। মাহামুদুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
গত ১৯ জুলাই রাজধানীতে তোলপাড়। ওই দিন মাহাবুবের রহমান চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকে বারবার ছেলেকে ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন। একবার শুধু ছেলে বলেছিল যে সে বাড়ির পাশে তার ‘জেনারেল স্টোর’ দোকানে আছে। তখন অপরিচিত এক ব্যক্তি ফোন তুলে ছেলের মৃত্যুর খবর দেন। ছেলের মোবাইল ফোন ফেরত দেওয়া হয়নি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছেলের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান পরিবারের সদস্যরা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘বন্দুকের গুলি’। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা মাহামুদুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
বাবার কথার শেষ ছিল না। ছেলেকে কখনো নাম ধরে ডাকতেন না, বাবা ডাকতেন। তিনি মনে করতে পারেননি যে তিনি তার ছেলেকে কখনো বকাঝকা করেছেন বা তাকে রাগান্বিত করেছেন। বাবা সেদিনের কথা উল্লেখ করে (১৯ জুলাই) বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়। ব্যাথার কারন বুঝলাম না। এখন বুঝলাম, আমিই বাবা, ছেলে মরছে, তাই হয়তো তখনই বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে।’
সেদিন এমন বিপর্যয় ঘটবে ভাবিনি। জানলে ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতাম।
আফরোজা রহমান, মাহামুদুর রহমানের মা
১১ সেপ্টেম্বর মাহামুদুরের বয়স হবে ২০ বছর। বাবা বলছিলেন এই ঈদে ছেলে টিউশনির টাকা দিয়ে একটা শার্ট কিনেছে। ঈদের আগে ওই পোশাক পরা ছেলেকে বললেন, ‘আজ থেকে আমার ঈদ শুরু হয়েছে।’
মাহামুদুর রহমানের মা আফরোজা রহমান কান্নার কারণে প্রথমে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। পাশে বসে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাহাবুবের রহমান। ঈদে ছেলেও মায়ের জন্য কাপড় কিনেছে। কাপড় সেলাইয়ের জন্য দর্জিকে আলাদা টাকাও দেন। সেই পোশাক এখনো তৈরি হয়নি।
মা জানান, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে ছেলে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে আসে। তারপর চাবি নিয়ে দোকানে যায়। এরপর একবার বাড়িতে এসে ছেলেটি জানায়, তার এক বন্ধুর পায়ে গুলি লেগেছে। একথা বলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। মা নামাজ পড়ায় ছেলের সাথে কথা বলেনি। আফরোজা রহমান বলেন, ‘সেদিন এমন বিপর্যয় ঘটবে ভাবিনি। জানলে ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতাম।
মাহামুদুরের বাবা জানান, ছেলেটি বাড়ির সামনের রাস্তায় ক্রিকেট খেলত। নিচে এসে অন্য ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখে সে অজ্ঞান হয়ে ছেলেটিকে খুঁজতে থাকে। তারপর যখন মনে হয় ছেলে নেই, তখন নিজেকে শান্ত রাখা যায় না।
শাহরিনা আফরোজ ও সাবরিনা আফরোজের একমাত্র ভাই ছিলেন মাহামুদুর রহমান। দুই বোন আদর করে ভাইকে টুনা বলে ডাকতেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর সাবরিনা আফরোজ ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, কত খুশি ছিলাম আমরা। এখন বুকটা খালি, কিছুই না। না, না… আমাদের কলিজা গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।’
অনেকের কাছ থেকে সাবরিনা আফরোজের মোবাইল ফোনে সেদিনের বেশ কিছু ছোট ছোট ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী, বিকেল ৩টা ৩৭ মিনিটে মাহামুদুর মারা যান। গুলিটি তার কানের পাশ দিয়ে গিয়ে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সড়কে পড়ে যান মাহামুদুর। কয়েকজন তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মাহামুদুর রহমান জিমে যোগ দেন। বোনেরা তাদের বাহুর পেশী দেখাতো, পাঞ্জা দিয়ে যুদ্ধ করতে চাইতো। সেই টগবগ ভাই আজ মারা গেছে। সাবরিনা বলেন, ‘পুলিশ গুলি করবে কেন? গুলি ভাইয়ের হাতে বা পায়ে লাগলেও ভাই বেঁচে থাকত।’
আমরা কত খুশি হয়েছিলাম। এখন বুকটা খালি, কিছুই না। না, না… আমাদের কলিজা গুলি করা হয়েছে।
ফেসবুকে সাবরিনা আফরোজের পোস্ট
পাশে বসা বাবা মাহাবুবের রহমান বলছিলেন, আমার ছেলে এত লম্বা না হলে মনে হয় বুলেট হত না।
মাহাবুবের রহমান ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সৌদি আরবে কাজ করেন। সাত-আট বছর আগে দেশে ফিরেছেন। সে সংগ্রাম করছে
বাড়ির সামনে পোস্টার লাগিয়েছে ‘শৈশব মেলা বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। মাহামুদুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি সবার কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে। মাহামুদুরের বাবা জানান, ছেলেটি বাড়ির সামনের রাস্তায় ক্রিকেট খেলত। নিচে এসে অন্য ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখে সে অজ্ঞান হয়ে ছেলেটিকে খুঁজতে থাকে। তারপর যখন মনে হয় ছেলে নেই, তখন নিজেকে শান্ত রাখা যায় না।