পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে ফেলে দিতে পারে
সাঁজোয়া পুলিশের গাড়ি থেকে একজনকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি একটি সাঁজোয়া যানের চাকার কাছে রাস্তার উপর শুয়ে ছিলেন। এরপর সাঁজোয়া যান থেকে নেমে যান পুলিশের এক সদস্য। এক হাত ধরে তাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেল রাস্তায়। এখানেই শেষ হয়নি, পরে কয়েকজন পুলিশ তাকে রোড ডিভাইডারের ওপর দিয়ে টেনে অন্যপাশে ফেলে দেয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে এ ঘটনা ঘটে।
যাকে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তার নাম শায়খ আশহাবুল ইয়ামিন। তিনি রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন, এমআইএসটির ওসমানী হলে থাকতেন। সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায় বাড়ি। পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধুরা তাকে ইয়ামিন নামে ডাকত।
মঙ্গলবার সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকার বাসায় কথা হয় ইয়ামিনের বাবার। মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কেউ একজন জীবিত মানুষকে এভাবে নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারো কাছে বিচার চাই না। আমি জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করা হয়নি। আমি ফয়সালা শুধু আল্লাহর কাছে দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধারণ করতে পারি।
ইয়ামিনকে এভাবে ফেলে দেওয়ার ভিডিও তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার দুই দিন পর ভিডিওটি দেখেন মহিউদ্দিন। তবে ভিডিওটি বর্তমানে ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অনেকেই ভিডিওটি ডাউনলোড করেছেন।
মহিউদ্দিন জানান, ছেলে ইয়ামিনের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাকে নিয়ে নানা কথা বলেছে মানুষ। তিনি চান সবাই তার ছেলে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুক।
ইয়ামিনের জন্ম 12 ডিসেম্বর, 2001। তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। এই দুটি পরীক্ষার পাশাপাশি ইয়ামিন বাংলাদেশ রসায়ন অলিম্পিয়াড-গণিত অলিম্পিয়াডে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ও বিভিন্ন নথিপত্র প্রস্তুত করেছিলেন। বাবা মহিউদ্দিন ছেলের প্রতিটি সার্টিফিকেট দেখিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন।
ইয়ামিনের মা নাসরিন সুলতানা একজন গৃহিণী। বোন শেখ আশহাবুল জান্নাত, তিনি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। মা-বোন ইয়ামিনের কথা বলতে চাননি।
ইয়ামিনকে সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায় দাফন করা হয়েছে। মা নাসরিন সুলতানা তার কবরে একটি তুলসী গাছ ও একটি ফুলের চারা রোপণ করেন।
আবাসিক এলাকার ভেতরে শহীদ মিনারে ইয়ামিনের ছবি সম্বলিত ব্যানার টানানো হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্যরা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন।
মহিউদ্দিন একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, শিশুর মৃত্যু মানেই অনন্ত কষ্ট। ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যার ভিডিও দেখলে আরো বেদনাদায়ক।
ইয়ামিনের বাবা অভিযোগ করেন যে তার ছেলেকে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চাই না আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের মোহরা হোক। আমার ছেলে রাজনীতি সচেতন ছিল। আমি রাজনৈতিকভাবেও সচেতন। কিন্তু আমি কোনো পার্টি করি না। ছেলে বুয়েট ও রংপুর মেডিকেল কলেজেও চান্স পায়নি। ছোটবেলায় পড়েন সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। পরে এমআইএসটিতে ভর্তি হন। এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই রাজনীতি করার সুযোগ নেই।
মহিউদ্দিন বলেন, “তবে আমরা ধার্মিক পরিবার। ছেলেটি নামাজ পড়ত। মুখে ঝোপ-ঝাড় দাড়ি ছিল। এটা দেখে কেউ যদি আমার ছেলেকে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির বা জামায়াতে পরিণত করার চেষ্টা করে, আমরা তা করব না। এটা ঘটতে অনুমতি দিন।
কি হয়েছিল সেদিন
মহিউদ্দিন বলেন, ফেসবুকে ভিডিওটি অনেকেই দেখেছেন। পরিবারের সদস্যরাও ভিডিওটি দেখেছেন। তা ছাড়া, তারা সঠিকভাবে জানে না সেদিন আসলে কী হয়েছিল। ইয়ামিনের বন্ধু ও অন্যরা ঘটনার খবর জানতে পারে।
১৭ জুলাই সকালে ইয়ামিন এমআইএসটি হল থেকে বাসায় ফেরেন। হল ছাড়ার নির্দেশ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইয়ামিনদের বাকবিতণ্ডা হয়। বাবা মহিউদ্দিন তার মৃত্যুর পর ইয়ামিনের একটি লেখা থেকে এটি জানতে পেরেছিলেন।
মহিউদ্দিন জানান, ইয়ামিন তার মা-বোনকে সব বলতেন। তবে তার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল না। ছেলে হল থেকে বাসায় ফেরার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।
মহিউদ্দিন বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর কেউ কেউ ফেসবুকে বলেছিলেন, ইয়ামিন আমৃত্যু রোজা রেখেছিলেন। এটা সত্য নয়।
১৮ জুলাই মহিউদ্দিন বাইরে যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইয়ামিন ছুটে আসে তার কাছে। আন্দোলনে তার কয়েকজন বন্ধু আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি। মিরপুরের দিকে তার পরিচিত কোনো হাসপাতাল আছে কি, যেখানে বন্ধুদের ভর্তি করা যায়।
মহিউদ্দিন তার ছেলেকে বলেন, নেই
এদিন জোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান মহিউদ্দিন। ইয়ামিনও নামাজ পড়তে গেল। রোজা থাকায় মহিউদ্দিন দুপুর ২টার দিকে মসজিদ থেকে বের হন। তিনি বাইরে এসে দেখেন তার মোবাইলে তার স্ত্রীর দুটি মিস কল। সে তার স্ত্রীকে ফোন করলে সে জানায়, ইয়ামিন তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বাসা থেকে বের হয়েছে। তখন বাড়ির সবাই ছেলেকে ডাকতে থাকে। কিন্তু ইয়ামিন ফোন ধরেননি।
ইয়ামিনের বন্ধুরা থাকেন সাভার ও মিরপুর এলাকায়। ওই দিন সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। তাই ছেলেকে খুঁজতে কোথায় যাবেন বুঝতে পারছিলেন না মহিউদ্দিন।
মহিউদ্দিন বলেন, “বাড়িতে টেলিভিশন নেই। তাই বাইরে থেকে কোনো খবর দেখতে পাচ্ছিলাম না। ইন্টারনেট কাজ করছিল না। তাই ফেসবুকে কোনো খবর খুঁজে পেলাম না। কিন্তু ততক্ষণে অনেক কিছুই হয়ে গেছে।
দুপুর ৩টার দিকে ইয়ামিনের মা ফোন পান তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলে। মহিউদ্দিন বলেন, ‘তখন ভেবেছিলাম ছেলেটা হয়তো আহত হয়েছে। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ছেলের নাম শুনে একজন বলল, ওটি (অপারেটিং রুমে) যাও। সেখানে যাওয়ার পর আরেকজন নিচতলায় যেতে বলেন। একজন মহিলা ডাক্তার এসে ইয়ামিনের মাকে জড়িয়ে ধরেন। ছেলের মৃত্যুর কথা ভাবিনি।
মহিউদ্দিন জানান, মহিলা চিকিৎসক তাদের একটি তালাবদ্ধ কক্ষে নিয়ে যান। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তালা খুললে দেখা যায়, ইয়ামিন স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। পরে জানা যায়, হাসপাতালে আনার আগেই তার ছেলে মারা গেছে। এখানে কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ পাননি চিকিৎসকরা। ছেলের বন্ধুরা জানান, ইয়ামিনকে প্রথমে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনো ক্লিনিক ভর্তি হতে রাজি হয়নি।
বাবা বলেন, তার ছেলের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইয়ামিনকে কেউ চোখ খোলা রাখতে বলে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা তখনও বেঁচে ছিল।
‘ইয়ামিন সাহসী ছিল’
মহিউদ্দিন জানান, পরিবারের সিদ্ধান্তের কারণে ইয়ামিনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, তারা দ্রুত ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করতে চেয়েছিলেন। ছাত্ররা বাইরে স্লোগান দিচ্ছিল। পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ায় হাসপাতালের কেউ কেউ লাশ দিতে ভয় পান। কেউ কেউ লাশ সরাতেও বাধা দেন। অন্যদিকে ইয়ামিনের লাশ নিয়ে মিছিল করতে চেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এরপর ছেলের এক বন্ধুর সহায়তায় অ্যাম্বুলেন্স এনে দ্রুত লাশ বাড়িতে আনা হয়।
মহিউদ্দিন জানান, ছেলেকে কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে এক আত্মীয় ফোন করে জানান, স্থানীয় থানা পুলিশ বলেছে অনুমতি ছাড়া লাশ দাফন করা যাবে না। দেশের অবস্থাও এমন ছিল যে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া বা কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে, সাভারে লাশ দাফনের ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের রিপোর্টও লাগবে। পরে এক পুলিশ বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি বলেন, লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করলে কোনো সমস্যা হবে না। তাই সাভারের এই আবাসিক কলোনীর কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করা হয়েছে।
মহিউদ্দিনের ভাষ্যমতে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাসহ বেশ কয়েকজন তাকে ফোন করে তার ছেলের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে যায় পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ
মহিউদ্দিন গর্ব করে বলেন, তার ছেলে সাহসী। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেন। ইয়ামিন সরাসরি ক্লাসে একজন শিক্ষককে বলেন, তাকে পড়ানো হচ্ছে না। দুই দিন পর ওই শিক্ষক স্বীকার করেন যে তিনি যেভাবে পড়াচ্ছিলেন তা সঠিক ছিল না।
ইয়ামিন মেধাবী বলে তার বাবা জানান। তিনি বলেন, বন্ধুরা কিছু না বুঝলে ইয়ামিন বুঝিয়ে দিতেন। ইয়ামিন বিতর্ক করতেন। ইয়ামিন এমআইএসটি-তে বিতর্ক ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন। বাবা বলেন, ছেলে বড় হলেও ছোট বাচ্চার মতো ‘টম অ্যান্ড জেরি’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্টুন দেখতেন।
মহিউদ্দিন জানান, অনেক আগে থেকেই বাবার নামে একটি ফাউন্ডেশন করার কথা ভাবছিলেন। ইয়ামিনের মৃত্যুর পর তিনি তার ছেলের নামে একটি ফাউন্ডেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। এই ফাউন্ডেশনের যে কোনো অনুদান ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের পরিবার বা আহতদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হবে।
কথা শেষ করে ফেরার সময় মোবাইল ফোনে ছেলের লাশের ছবি দেখিয়ে মহিউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, খুব কাছ থেকে রাবার বুলেটের আঘাতে ইয়ামিনকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে দেখবেন, বাম পাশের এক জায়গায় অনেক গুলিবিদ্ধ। তারপর তাকে সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়া হয়।